আজ এমন একজন সিংহ পুরুষের... |
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী ?মো. কামাল উদ্দিন আজ এমন একজন সিংহ পুরুষের স্মৃতি বুকে নিয়ে লিখতে বসলাম, যে ব্যক্তির ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না। যার প্রতিটি কর্ম মূল্যায়ন করা অল্প সময়ে সম্ভব হবে না। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামীলীগের প্রাণ, শিল্প উদ্যোক্তা, বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অন্যতম ব্যক্তি, বহুগুণে গুণান্বিত, দেশের গর্বিত সন্তান আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাই। বিগত তিন বছর পূর্বে বেশ কিছুদিন যাবত বাবু ভাই অসুস্থ পত্র পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়ে আসছে। সবার দৃষ্টি সিঙ্গাপুরের দিকে। অনেকের জল্পনা কল্পনা ছিল। বাবু ভাই এমন এক সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন যে সময় আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইকে দেশ ও জাতির স্বার্থে খুবই প্রয়োজন। বাবু ভাই চলে যাওয়াতে আমাদের কত পরিমান ক্ষতি হয়েছে যার সঠিক বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। দেখতে দেখতে তিনবছর অতিবাহিত হলো বাবু ভাই এর মৃত্যুও আজ ৩য় মৃত্যু বার্ষিকা। বাবু ভাইয়ের নাম শুনে আসছি ছোট বেলা থেকে। তবে বাবু ভাইয়ের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ১৯৮৮ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন ও আন্দোলনের কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে। বাবু ভাইয়ের একান্তু বন্ধু বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চট্টল বন্ধু এস এম জামাল উদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে। তবে আমার সাথে সম্পর্ক রাজনৈতিক নয়। সম্পর্কটা ছিল একান্ত আন্তরিক। বাবু ভাই যখন হুমায়ুন জহিরের হত্যার মিথ্যা মামলায় দেশ থেকে বিদেশ চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। উনার মনের দুঃখ প্রায় সময় প্রকাশ করত জামাল ভাইয়ের কাছে। ১৯৯৫ সালে ৫ জুন তৎসময় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব থেকে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আমি ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ৯ জুলাই অর্ধদিবস হরতাল ঘোষণা করেছিলাম। আমার দাবীর মধ্যে ছিল চট্টগ্রামে পৃথক শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা করা এবং আখতারুজ্জামান চৌধুরী মামলা প্রত্যাহার ও অন্যান্য দাবীসহ যখন রাজপথে আন্দোলন তুঙ্গে। তখন প্রশাসন হতে শুরু করে সব জায়গায় একই কথা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে আখতারুজ্জামান বাবু মামলা প্রত্যাহারের কি সম্পর্ক ? হরতালের পাঁচদিন পূর্বে শহীদ মিনারে জনসভার আয়োজন করি। জনসভায় দক্ষিণ জেলার আওয়ামী লীগের তৎসময়ের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান সভাপতিমোসলেম উদ্দিন সাহেব এবং তৎসময়ের প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতা খোরশেদ ভাই মিছিল সহকারে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ঘোষিত হরতাল কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। আমাদের মূল সংগঠন বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি হরতাল সফল ও শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা এবং আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাইয়ের মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে আন্দোলন জোরদার করার জন্য চট্টগ্রামের প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে মতবিনিময় করে সমর্থন আদায়ের সচেষ্ট ছিলেন। তৎসময় বাইশ মহল্লার সর্দ্দার থেকে শুরু করে প্রায় সংগঠন আমাদের দাবীর প্রতি জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন। ঐ সময় আমাদের প্রাণ প্রিয় নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী কলকাতা থেকে প্রায় সময় জামাল ভাইয়ের টেলিফোনের মাধ্যমে আমাদের সাথে কথা বলতেন। সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব মনোয়ার ভাই ব্যারিষ্টার পড়তে লন্ডন চলে যাওয়াতে, ফটিকছড়ির সাবেক এমপি মজহারুল হক শাহ চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাবু ভাই কলকাতা থেকে শুধু অনুশোচনা করতেন। আজকে আমার জন্য আন্দোলন করার জন্য জামাল উদ্দিন, মোসলেম উদ্দিন, কামাল উদ্দিন এবং খোরশেদ ব্যতীত কেউ নেই? আমি যাদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছি রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে তারা সবাই আজ অনেক দূরে “বিপদে বন্ধুর পরিচয়।” সেই বন্ধু ছিল এস এম জামাল উদ্দিন। ৯ জুলাই হরতাল বিষয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষে তৎসময় মাননীয় মন্ত্রী জনাব আবদুল্লাহ আল নোমানের সাথে ৮ জুলাই জামাল খানস্থ বিপিসি রেষ্ট হাউজে আমাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। মন্ত্রী নোমান সাহেব বাবু ভাইয়ের মামলা প্রত্যাহার ব্যতীত আমাদের প্রতিটি দাবীর প্রতি সমর্থন জানান এবং পূরণ করার কথা দেন। কিন্তু বারবার প্রশ্ন করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মামলার সাথে চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা দাবীর সম্পর্ক কি? হরতাল প্রত্যাহার করার জন্য আমাকে প্রশাসনিকভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। তৎসময়ের উপ-পুলিশ কমিশনার নজরুল সাহেব ও ডিজিএফআই এর লোকজন এক পর্যায়ে আন্দোলনের সব খরচ প্রশাসন তথা মন্ত্রী মহোদয় দিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিদেন। কারণ মন্ত্রী নোমান ভাইকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাঠিয়েছিল যেভাবে হোক সমাধান করতে হরতাল যেন না হয় এবং টেলিভিশনের ক্যামরাসহ সকল পত্রিকা আমার সিদ্ধানের অপেক্ষায় ছিল। আমি মন্ত্রী মহোদয়কে কৌশলগতভাবে বুঝ দিয়ে রেষ্ট হাউজ থেকে চলে এসে তড়িৎ গতিতে হরতাল পালনের সংবাদ পত্রিকা অফিসে ছেড়ে দিলাম। পুরো রাত পুলিশ চেষ্টা করেছিল আমাকে গ্রেফতার করতে এবং আমি আখতারুজ্জামান বাবু থেকে কত টাকা নিয়েছি তা উদঘাটন করতে। কাজীর দেউড়ী বাংলা হোটেলের নীচের নালা দিয়ে আমি এবং মাজহারুল হক শাহা চৌধুরী একাধিক কর্মী নিয়ে পুলিশের তাড়ানি খেয়ে আসকার দিঘীর পাড়স্থ তৎসময় গণফোরাম নেতা কামাল আজিজুল হক সাহেবের বাসায় উঠলাম। রাতে ষোলকবহর এক বাসায় আত্মগোপনে থেকে সকাল বেলা যথানিয়মে হরতাল পালন করলাম। ৮ জুলাই লিফলেট প্রচারের সময় আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সামনে থেকে একজনকে গ্রেফতার করেছিলেন। রাতে মৌশাল মিছিল করাকালিন একাধিক ছাত্রনেতাসহ ৯ জুলাই হরতাল চলাকালিন প্রায় অর্ধশত নেতা এবং মিরসরাই মিটাছড়া স্কুলের একাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করেন। অন্যদিকে জামাল ভাইয়ের টেলিফোনে আমাকে এবং জামাল ভাইকে বাবু মিয়া থেকে কত টাকা নিয়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর দালালি করছি ইত্যাদি ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করেছিলো অনেকেই। বিবেকের তাগিদে এবং চট্টগ্রামের বৃহত্তর স্বার্থে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির সম্মানিত উপদেষ্টা এবং প্রতিষ্ঠিত একজন শিল্পপতিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের আদর্শগত আন্দোলন ছিল। পরে সরকার পরিবর্তনের পর বাবু ভাই দেশে ফিরলেন। বাবু ভাই দেশে আসার পর সার্সন রোডস্থ বাবু ভাইয়ের বাসায় আমি এবং জামাল ভাই আমাদের সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন আমি বাবু ভাইয়ের কাছে না গিয়ে একটু দূরে সরেছিলাম। বাবু ভাই হাজারো মানুষের ভিড়ের মাঝ থেকে আমাকে খোঁজ করে কাছে নিয়ে উনার পাশে বসাইয়াছিলেন। সাথে জামাল ভাই মোসলেম উদ্দিনসহ অনেকে। আমাদের বসার স্থানটি ছিলো উনার ব্যক্তিগত রুমে। বাবু ভাই আমাকে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুভরা চোখে এবং গলাভারি কণ্ঠে বলেছিলো “কামাল” তুই জীবনে আমার কাছে যে কোন আবদার নিয়ে আসবি, আমি পুরণ করার চেষ্টা করব। কামাল তুই আমাকে ঋণী করে পেলেছিস। বাবু ভাইয়ের ঐ সময়ের আমার প্রতি আন্তরিকতাও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। এত বড় মাপের একজন মানুষ আমাকে আবেগতাড়িত বণ্ঠে আবদ্ধ করেছিলো। আমি বাবু ভাইয়ের কথায় কান্না করেছিলাম। জীবনে বহুবার বাবু ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। ঐ দিনের ভালোবাসাসুলভ কথাগুলো আমি ভুলতে পারি নাই। তবে বাবু ভাইয়ের কাছে আমি কিছু চাই নাই। শুধু চেয়েছি স্নেহ ও ভালোবাসা তা পেয়েছি। আজ বাবু ভাই আমাদেরকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। আমরা সবাই চলে যাব। এর আগে জামাল ভাইসহ অনেকে চলে গেছে। কিন্তু বাবু ভাইয়ের আবেগময় কথাগুলো যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার মনে থাকবে। একজন সত্যিকারের চট্টগ্রামের অভিভাবক আজ থেকে তিন বছর আগে কোটি কোটি ভক্তদের কাঁদিয়ে সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর কাছে আমাদের চাওয়া পাওয়া কিছু নেই। বাবু ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন জানিয়ে শেষ করছি। ?লেখক:মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি এবং লেখক ও গবেষক।| |